ঝিনাইদহ প্রতিনিধি-
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের সোলেমানপুরে হাজী আমলানেছা বিবি ওয়াকফ্ এস্টেট মসজিদের সম্পদ আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে মসজিদের মুতাওয়াল্লী ইমরান হোসেন ওরফে তাপসের বিরুদ্ধে। এস্টেট পরিচালনার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তিনি বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়ম, লোকচক্ষুর আড়ালে বাগান ইজারা দেওয়া, এস্টেটের সম্পদ আইন বহির্ভূত বন্ধক রাখা, গোপনে গাছ বিক্রি করা, গাছ বিক্রির নামে টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়া, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে হুমকি-ধামকি দিয়ে একক আধিপত্য বিস্তার করা, প্রতিবাদীদের দমিয়ে রাখতে মিথ্যা মামলা দেয়া, আম বাগান ইজারার লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করা, মসজিদের ইমাম- মুয়াজ্জিনের বেতন না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ স্থানীয় ও মসজিদের মুসল্লিদের। স্থানীয় ও মুসল্লীদের ভাষ্যমতে জানা গেছে, হাজী আমলানেছা বিবি ওয়াকফ্ মসজিদের প্রায় ১৮ বিঘা সম্পদ থেকে প্রতি বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন খাত থেকে প্রায় ৫ থেকে ৭ লক্ষ টাকা আয় হয়। শর্ত মোতাবেক খরচ করার কথা থাকলেও তা না করে মুতাওয়াল্লী তাপস একের পর এক আত্মসাৎ করে চলেছেন। তিনি মসজিদের সম্পদ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ টাকা সেসব শর্তে খরচ না করে উল্টো স্টেটের সম্পদের টাকা দিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপনের পথ বেছে নিয়েছে।
এর আগে তার বাবা খন্দকার আব্দুল আলীকেও দুর্নীতির দায়ে মুতাওয়াল্লী থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন সময়ে তিনি এস্টেটের ঈদগার পাশে থাকা একটি বৃহৎ বটগাছ স্থানীয় ইটভাটা মালিক ব্লু মিয়ার কাছে ১ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে দেয়। সেসময় স্থানীয়রা টের পেয়ে গাছ কাটা বন্ধ করে। আইন বহির্ভূত এসব কর্মে লিপ্ত হওয়ার অপরাধে খন্দকার আব্দুল আলীকে মুতাওয়াল্লী থেকে বাদ দিয়ে স্থানীয়রা কমিটি গঠনের মাধ্যমে এস্টেট পরিচালনা করে আসছিলেন। গত মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর ) সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে মসজিদের ইমাম, মুসল্লিসহ স্থানীয় বাসিন্দারা সাংবাদিকদের কাছে এসব অভিযোগ তোলেন।
এলাকাবাসী জানান, হাজি আমলানেছা বিবি নিসন্তান থাকায় তার নামীয় ৭২ বিঘা সম্পত্তির প্রায় সবটুকুই তৎকালীন সময়ে বেদখলে চলে যায়। তার দখলে থাকা বাকি সম্পত্তি মৃত্যুর পর “সৃষ্টিকর্তার পরম করুনা পাওয়ার আশায়” কিছু শর্তসাপেক্ষে মসজিদের নামে ওয়াকফ্ করে দেন। পরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অনুসন্ধানে ও স্থানীয়দের দেখানো মতে এই সম্পত্তির ৬ শতকের উপর ২০১১ সালে স্থাপিত একটি মসজিদ দেখা গেছে। মসজিদের নাম করণ করা হয়েছে হাজি আমলানেছা বিবি এস্টেট মসজিদ। দলিলে থাকা শর্ত অনুযায়ী তৎকালীন সময় থেকে মসজিদের মুতাওয়াল্লীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন আমলানেছা বিবি পরিবারটির সদস্যরা। কিন্তু বর্তমান মুতাওয়াল্লী তাপসের বাবা মৃত- খন্দকার আব্দুল আলী’র পরিচালনার আমল থেকে শুরু হয়েছে প্রশ্ন বিদ্ধ। স্থানীয়দের করা কমিটি দীর্ঘ ৮ বছর পরিচালনার পর আওয়ামী সরকার আমলে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ও স্থানীয় আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী দিয়ে স্টেটটি কমিটির কাছ থেকে জবরদখল করে নেন তাপস। এরপর থেকে এস্টেটের লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ মসজিদ ভিত্তিক খরচ না করে, ইমরান হোসেন তাপস লুট পাট করে খেয়ে যাচ্ছেন। এমনটিই অভিযোগ স্থানীয় মুসল্লিদের। তারা আরো অভিযোগ করে বলেন, গত ১১ মাস মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের ১ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকা বেতন বাকি, অথচ দান বাক্সের মধ্যে ১ লক্ষ টাকা এবং টেবিলের ড্রয়ারে থাকা ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা আমরা লুট করে নিয়েছি বলে মিথ্যা মামলা দিয়েছে তাপস। এছাড়াও মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন মসজিদের মিনার ভেঙেছি, মসজিদের কাগজপত্র পুড়িয়েছি। তারা বলেন, এতো টাকা মসজিদে কারা দান করলো ? আর এতো টাকা মসজিদে গচ্ছিত থাকলে তিনি ঢাকায় থেকে জানলেন অথচ মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিন জানেনা এটা কেমন কথা ? তাছাড়া এতো টাকা মসজিদে রেখে গরিব ইমাম ও মুয়াজ্জিনের ১১ মাস কেনো বেতন দেওয়া হয়নি ? মিডিয়ার মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে এই প্রশ্ন রইলো। স্থানীয় মুসল্লিরা আরো বলেন, এস্টেটের প্রায় ১৪ বিঘা জমির উপর আম বাগান রয়েছে। এর আগে কমিটির মাধ্যমে পরিচালনার সময় ৭ বিঘার উপর আম বাগান ছিল। তখন প্রতি ২বছর অন্তর অন্তর ২দিন ব্যাপি মাইকিং করে ইজারা দেওয়া হতো। সেসময় ঐ আম বাগান প্রায় ৪ লক্ষ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান আরো ৭বিঘা বাড়ানো হয়েছে। মুতাওয়াল্লী তাপস দায়িত্ব নিয়ে ৩ বার ইজারা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তিনি ইজারা দেওয়ার সময় কেউ যাতে জানতে না পারে এজন্য মাইকিং না করে গোপনে ইজারা দিয়ে আসছে। এলাকাবাসী বলেন, আমাদের ধারনা মতে বর্তমানে ঐ আম বাগান ৭ থেকে ৮ লক্ষ টাকা ইজারা হওয়ার কথা। এছাড়াও ২ বিঘা মত ধানি জমি কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়। বছরে প্রতি বিঘা জমি থেকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আসে। এতো টাকা তিনি কোথায় খরচ করেন তা আমাদের চোখে পড়েনি। এদিকে এস্টেটের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেও তিনি ক্ষ্যান্ত হননি, অবৈধভাবে এস্টেটের জমি বন্ধক রাখাসহ ২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকার গাছ বিক্রি করেছে। এবিষয়ে উপজেলার পাশপাতিলা গ্রামের আবুল হাসানের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন (কাঠ ব্যবসায়ী) অভিযোগ করে বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে মুতাওয়াল্লী তাপস ১৫০ টি আম গাছ বিক্রি করবে বলে আমার সাথে কথা হয়। ৬০ হাজার টাকা দাম ঠিক করে পুরো ৬০ হাজার টাকাই আমার কাছ থেকে অগ্রিম নেয়। এই গাছ ১ মাসের মধ্যে কেটে নেওয়ার কথা বলে মুতাওয়াল্লী তাপস। পরে গাছ কাটতে গেলে স্থানীয়দের মাধ্যমে তিনি এস্টেট সম্পত্তির গাছ জানতে পেরে, গাছ না কেটে টাকা ফেরত চান। সেসময় মুতাওয়াল্লী ১ সপ্তাহের সময় নিলেও আজ অবধি সেই টাকা ফেরত না দিয়ে বরং টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে আমাকে খুন-যখমের ভয় দেখাচ্ছেন। পরে নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে আমি কোর্ট চাঁদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করি মুতাওয়াল্লী তাপসের বিরুদ্ধে। এছাড়াও স্থানীয় পালবাড়ি এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের কাছে ৪টি আম গাছসহ মোট ৫টি গাছ ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করে তাপস। এর আগে কল্যাণপুর সর্দারপাড়া এরিয়া থেকে স্টেটের ১৭০ টি গাছ ২০ হাজার টাকায় বিক্রির কথা বলে রাজ্জাকের কাছ থেকে ২হাজার টাকা বাইনা নেয়।পরে রাজ্জাক সেগুলো এস্টেটের গাছ জানতে পেরে, গাছ না কেটে বাইনার ২ হাজার টাকা ফেরত চাই। কাঠ ব্যবসায়ী রাজ্জাককেও বায়নার টাকা ফেরত দেয়নি মুতাওয়াল্লী তাপস। কাঠ ব্যবসায়ীরা সাংবাদিকদের জানান, গাছ না নিলে বায়নার টাকা ফেরত দেওয়া হবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে মুতাওয়াল্লী তাপস। এস্টেট মসজিদের ইমাম ফয়সার রহমান জানান, তার বেতন ৮ হাজার টাকা। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে আজ অবধি তার বেতন দেওয়া হয়না। মসজিদে হামলা ভাংচুরের বিষয় জানতে চাইলে মুতাওয়াল্লী তাপসের চাচা জানান, মসজিদের উপরে নিজের নাম ব্যবহার করে একটি নাম ফলক বানিয়েছিল তাপস। মসজিদের ছাদের উপরে নামফলক থাক এটা মুসল্লীদের চোখে দৃষ্টিকটু দেখালেও বিগত সরকারের আমলে ভয়ে কিছু বলতে পারেনি। বলতে গেলেই তিনি বিভিন্ন হুমকি-ধামকি এবং মামলার ভয় দেখান।
গত ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তন হলে মুসল্লিরা সেই নামফলক ভেঙে দিয়েছে। তিনি বলেন, মুসলমান হয়ে কেউ মসজিদ ভাঙতে পারে ? যদি কেউ এধরণের অভিযোগ দিয়ে থাকে তবে সে মিথ্যা বলেছে। হাজি আমলানেছা বিবি ওয়াকফ্ এস্টেট মসজিদের মুসল্লিরা ক্ষোভে ফুঁসে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উদ্যেশ্যে বলেন, এই মিথ্যাবাদী, প্রতারক, মামলাবাজ ও টাকা আত্নসাতকারী মুতাওয়াল্লী ইমরান হোসেন তাপসকে দ্রুত অপসারণ করে মসজিদের সম্পদ রক্ষার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। সেই সাথে তাকে আইনের আওতায় এনে তার দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের সমস্ত হিসাব মিলিয়ে নেওয়ার জন্যও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এবিষয়ে তথ্য জানতে হাজি আমলানেছা বিবি ওয়াকফ্ এস্টেটের মুতাওয়াল্লী মোঃ ইমরান হোসেন তাপসের মোবাইলে ফোন দিলে প্রথমে তিনি বিভিন্ন ইঙ্গিতে প্রতিবেদককে ভয়-ভীতি দেখানোর চেষ্টা করে। পরে অফিসিয়ালি ছাড়া তথ্য দেওয়া যাবেনা বলে জানান তিনি।