নিজস্ব প্রতিবেদক ঝিনাইদহ –
মোঃ ইব্রাহীম হোসেন (৭৬) বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় বাড়িতে শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছেন। ছোটবেলার খেলার সাথী, ছাত্রজীবনের বন্ধু, দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরের কর্মজীবন ও দুরুন্ত শৈসব-কৈশরের স্মৃতি হাতড়িয়েই দিন কাটছে। ২০০৯ সালে স্ট্রোক করার পরে অনেকেরই নাম ভুলে গেছেন। এক ছেলে এক মেয়ের জনক মোঃ ইব্রাহীম স্বাস্থ্য বিভাগে ৩০ বছর চাকরির পর অবসরে গেছেন। এখন ছেলে ও নাতীরাই তার দেখাশোনা করেন। তেমন কোন আক্ষেপ নেই। আক্ষেপ শুধু একটি লাঠি নিয়ে। লাঠিটি তিনি প্রায় ৬০ বছর আগলে রেখেছেন। প্রায় প্রতিদিনই স্মৃতি মনে পড়লে বের করে নাড়াচাড়া করে দেখেন। হরিণের শিং দিয়ে তৈরি সাহেবী লাঠিটি তিনি খুলনা থেকে কিনেছিলেন, বাঙালীর রাখাল রাজা স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানকে উপহার দেওয়ার জন। শেখ মুজিবের মানুষকে ভালোবাসার, কাছে টানার যাদুকরি ক্ষমতা কিশোর ইব্রাহীমকে বস করেছিল। কৈশর-যৌবনে দেখা শেখ মুজিবকে তিনি আজও তার স্বপ্নের নায়ক ভাবেন। নাতিদের কাছে বলেন কিশোর-যৌবনের স্মৃতি গল্প। মোঃ ইব্রাহীম হোসেন বর্তমান মাগুরা জেলার সদর উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের ফুলবাড়ি গ্রামের মৃত মোলাজ হোসেনের ছেলে। মাত্র দেড় বছর বয়সে মারা যায় বাবা, ৩ বছর বয়সে মারা যায় মা। বড় ভাইয়ের হাতে অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছেন। মোঃ ইব্রাহীম হোসেন হাইস্কুলে ভর্তি হন মাগুরা মডেল স্কুলে। এই স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় এসডিপিওকে মেরে সেই সময়ে খবরের শিরোনাম হন। সেই যাত্রায় স্কুলের হেড মাস্টার তিনিসহ অন্যান্য ছাত্রদের রক্ষা করেন। চাকরি জীবনে একবার ডিস্ট্রিক্ট ম্যালেরিয়া এজুকেশন অফিসার (ডিএমইও) কে মেরে চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। এমন অসংখ্য দস্যিপণার গল্প আছে তার জীবনে। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের এক জনসভার আয়োজন করা হয় মাগুরার নোমানীর ময়দানে। তখন মাগুরার আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আতর আলী। শেখ সাহেবকে উপহার দেওয়ার জন্য কিশোর ইব্রাহীম খুলনা থেকে হরিণের শিং দিয়ে তৈরি লাঠিটি কিনে আনেন। জনসভার দিন শেখ সাহেব আসেন। কিন্তু সেদিন আবহাওয়া ছিল দুর্যোগ পূর্ণ অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি মঞ্ছ থেকে নেমে যান। দুর্যোগের কারণে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। সেদিন উপহারটি তার হাতে আর তুলে দেওয়া হয়ে ওঠেনি। এর পরেও শেখ সাহেব ১৯৬৯ সাল ও সত্তরের নির্বাচনে মাগুরায় আসেন কিন্তু তার হাতে আর উপহারটি তুলে দেওয়া হয়নি। দেশ স্বাধীনের পরে ঢাকার ৩২ নম্বরের বাড়িতেও তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেছেন। মাগুরাই কোন মঞ্চে তিনি উপহারটি তুলে দেওয়ার জন্য রেখেদেন। স্ত্রীকে যতœকরে বাক্সে রেখেদেন। ইব্রাহীম হোসেন ১৯৬৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলেজে ভর্তি হন। সেবছর ম্যালেরিয়া সুপার ভাইজার পদে চাকরিতে যোগদেন। অ্যাড: সোহরাব হোসেন, অ্যাডভোকেট আছাদুজ্জামান সহ মাগুরার প্রবীণ রাজনীতিবিদদের সাথে তার অনেক স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাগুরার আলমখালী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের খাদ্য গুদামের পাহারদার হিসেবে কাজ করেছেন। তার এক চাচাতো ভাই ওহিদুল ইসলাম শৈলকুপার কামান্নায় পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শহিদ হন। আসাদুজ্জামান সেসময় তাকে সনদ নিতে বললেও তিনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেননি। ১৯৭২ সালে ঝিনাইদহ শহরে বিয়ে করেন। সংসার চাকরির মধ্যে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হন। দেশের প্রেক্ষাপট পাল্টিয়ে যায়। বঙ্গবন্দুর জন্য রাখা উপহারটি আজীবনের জন্য বাক্স বন্দি হয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালে ঝিনাইদহ শহরে জমি কিনে বাড়ি করে স্থায়ী হন ইব্রাহীম হোসেন। স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদ থেকে ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। ২০০৮ সালে হজ¦ করেন। কিন্তু ২০০৯ সালে স্ট্রোক করে হারিয়েছেন অনেক স্মৃতি ও স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা। কৈশর যৌবনের অনেক সাথী ও বন্ধুদের নাম মনে নেই। তাদের বেশির ভাগই মারা গেছেন। গত ১০ ডিসেম্বর তিনি আবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ঝিনাইদহ জেনারেল হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে এখন কিছুটা সুস্থ কিন্তু চিন্তা কখন যেন চলে যেতে হয়। ইব্রাহীম হোসেন বলেন, আমি অনেক কিছু ভুলে গেছি। বন্ধু-সাথীদের নাম মনে নেই। লাঠিটি বের করে প্রায়ই দেখি। আমার একটাই আক্ষেপ। বঙ্গবন্ধুর জন্য কেনা উপহারটি তাকে দিয়ে যেতে পারলাম না। তার উত্তরাধীকার কারও হাতে দিতে পারলেও শান্তি পেতাম। তিনি বলেন, যদি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাতে লাঠিটি দিতে পারলে আমার আর কোন আক্ষেপ থাকতো না। তিনি বলেন, শেখ সাহেব আমাকে ইব্রা বলে ডাকতে। তার সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। মাগুরায় ভোটের প্রচারণা করেছি তার সাথে। ইব্রাহীম হোসেনের একমাত্র ছেলে দীপু (কলেজ শিক্ষক) বলেন, আমার বাবা আমাদের কাছে প্রায়ই আক্ষেপ করেন আর লাঠিটি বের করে দেখেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতে যদি তিনি উপহারটি তুলে দিতে পারেন। আওয়ামী লীগের নেতাসহ প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের কাছে বিনীত অনুরোধ আমার বাবা অন্তঃপ্রাণ মুজিব ভক্ত ছিলেন, তার শেষ জীবনের এই ইচ্ছাটা যেন পূরণ করা হয়।