টিবিএস ডেস্ক-
পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা কেবলই বাড়ছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে প্রায় আটশ কোটি। কিন্তু পৃথিবীতে মানুষের সংখ্য ঠিক কত পর্যন্ত ধারণ করতে পারবে এ গ্রহটি?
৫০ হাজার থেকে এক লাখ বছর আগে এ পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ছিল কেবল ১০,০০০ জন। এরপর ধীরে ধীরে সংখ্যাটা ক্রমশ বেড়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা যেমন উঠেছে, তেমনি অনেকে আবার মনে করছেন, আমাদের আসলে আরও জনসংখ্যার প্রয়োজন। ২০১৮ সালে টেক বিলিয়নিয়ার জেফ বেজোস বলেছিলেন, একটা সময় মানুষের সংখ্যা ট্রিলিয়নে ছাড়িয়ে যাবে আর এ মানুষগুলো পুরো সৌরজগতজুড়ে বাস করবে। বেজোস ঘোষণা দিয়েছিলেন, এমন ভবিষ্যৎ অর্জনের জন্য তিনি কাজও শুরু করেছেন।
অন্যদিকে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখেন অনেকেই। এদের তালিকায় আছেন বিখ্যাত প্রকৃতি-ইতিহাসবিদ স্যার ডেভিড অ্যাটেনবারাও। তার মতে আমাদের এ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা “পৃথিবীর বুকে একটি প্লেগের” মতো। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, জলবায়ু সংকট, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি থেকে শুরু করে জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব; আমাদের সবধরনের পরিবেশগত সংকটের পেছনে জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিই দায়ী।
১৯৯৪ সালে বৈশ্বিক জনসংখ্যা ছিল কেবল ৫৫০ কোটি। তখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গবেষণা করে জানিয়েছিলেন, পৃথিবীর আদর্শ জনসংখ্যা হলো ১৫০ থেকে ২০০ কোটি। তাহলে কি আমাদের পৃথিবী ইতোমধ্যে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভার বহন করছে?
মেসোপটেমিয়ান কিংবদন্তিতে দেখা যায়, পৃথিবীর মানুষদের সৃষ্টি করা ‘আওয়াজ’ ও ‘শোরগোলে’ বিরক্ত হয়ে পরিবেশের দেবতা এনলিল মানুষের সংখ্যা কমানোর জন্য পৃথিবীতে প্রতি ১২০০ বছর অন্তর প্লেগ, দুর্ভিক্ষ, খরা ইত্যাদির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু আরেক দেবতা তা-তে বাদ সাধলে এনলিল বিশাল বন্যার সৃষ্টি করেন।
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রের উচিত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা। তার মতে, একটি আদর্শ শহরের জনসংখ্যা কোনো ক্রমেই ৫,০৪০ জনের বেশি হওয়া উচিত নয়। প্লেটো আরও একটি বিষয়ে ভেবেছিলেন। সেটি হলো মানুষের ভোগের পরিমাণ কেমন হবে তা। আজকের দিনেও দারুণ একটি বিতর্ক হচ্ছে: সমস্যাটা কি আসলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নাকি মানুষ কীভাবে সম্পদ ভোগ করে তার সঙ্গে সম্পর্কিত?
১৭৯৮ সালে ইংরেজ পাদরি টমাস ম্যালথুস তার (দ্য প্রিন্সিপল অভ পপুলেশন) শীর্ষক লেখায় দুইটি বিষয়কে নির্দেশ করেছিলেন। একটি হলো সব মানুষকে খেতে হয়, এবং অন্যটি- সবাই সঙ্গম করতে পছন্দ করে। এ দুই ধারণা থেকে তিনি সিদ্ধান্ত দেন, এগুলোর কারণে একসময় মানুষের চাহিদা পৃথিবীর সম্পদের তুলনায় ছাড়িয়ে যাবে। ম্যালথুস যখন এটি লিখেছিলেন, তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ৮০ কোটি। ম্যালথুসের এ তথ্যের পর কিছু মানুষ মনে করেছিলেন মানুষের জন্মনিয়ন্ত্রণ করা উচিত। আরেকটি পক্ষের কাছে মনে হয়েছিল, জন্মনিয়ন্ত্রণ একটি অনৈতিক কাজ, বরং মানুষের উচিত খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো।
দিল্লিতে একটি বস্তিতে মানুষের সংখ্যা দেখার পর ১৯৬৮ সালে (দ্য পপুলেশন বম্ব) নামকে একটি বই লিখেছিলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল এরলিচ, ও তার স্ত্রী অ্যান এরলিচ। জনসংখ্যার এ পরিমাণ বৃদ্ধি দেখে তারা মনে করেছিলেন, ভবিষ্যতে একটি গণ-দুর্ভিক্ষের সমূহ সম্ভাবনা আছে। তাদের এ গ্রন্থটি যথেষ্ট সমালোচনার শিকারও হয়েছিল। বর্তমানে অতিরিক্ত জনসংখ্যা নিয়ে যে দুশ্চিন্তা, তার অনেকগুলো তৈরিতে এ বইটি ভূমিকা রেখেছিল বলেও মনে করা হয়।
পৃথিবীর প্রমিত জনসংখ্যা নিয়ে এ আলাপ সবসময় অ্যাকাডেমিক দুনিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল না। অনেক সময় এ ধারণাটি ব্যবহার করে শক্তিশালীরা দুর্বলদের ওপর বৈষম্য চালিয়েছে। জাতিগত নিধন, জেনোসাইড ইত্যাদির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জনসংখ্যার আলাপটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীদের জোরপূর্বক নির্বীজন (স্টেরালাইজ) করা হয়। ১৯৮০ সালে চীন তাদের বিতর্কিত এক-সন্তান নীতি চালু করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দোহাই দিয়ে।
২০৭০ বা ২০৮০ সালের মধ্যে আমরা ‘পিক হিউম্যান’ মুহূর্তে পৌঁছাব। তখন বৈশ্বিক জনসংখ্যা হবে ৯৪০ থেকে ১০৪০ কোটি। জাতিসংঘের ধারণা অনুযায়ী, জনসংখ্যা ১০৪০ কোটিতে পৌঁছানোর পর এ সংখ্যাটি মোটামুটি দুই দশক স্থির থাকবে। এরপর জনসংখ্যা ক্রমশ আবার কমতে থাকবে।
জনসংখ্যা নিয়ে এত বিতর্ক ও অনিশ্চয়তার কারণে কোনো বিষয়ে সঠিকভাবে আগাম চিন্তা করা যাচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে পৃথিবীর জনসংখ্যা নানাভাবে আমাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে।
বিভিন্ন সময় নানা ওয়াইল্ডলাইফ ডকুমেন্টারিতে বিভিন্ন বন-জঙ্গল, ও বন্যপ্রাণী দেখে মানুষ মুগ্ধ হন। দর্শক ওই বনগুলো দেখে এটা ভেবে খুশি হন যে সেগুলোতে এখনো মানুষের কোনো স্পর্শ লাগেনি।
কিন্তু বাস্তব হলো, এসব ডকুমেন্টারিগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে পর্দায় কোনো মানুষ বা মানববসতি দেখা না যায়। অথচ এসব বনের খুব কাছেই মানুষ অবস্থান করে। ডকুমেন্টারিগুলোতে এভাবে ‘বুনো মিথ’ তৈরি করা হলেও স্যাটেলাইটে ধরা পড়া বন-ধ্বংসের ছবিগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বাস্তবতাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর তথ্যমতে, পৃথিবীর মোট ভূখণ্ডের ৩৮ শতাংশ তথা ১২৪০ কোটি একর খাবার ও অন্যান্য বস্তু (যেমন তেল) উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয়।
২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত বিশ্বে কেবল একটি সন্তান কম গ্রহণ করলেই, প্রতি একক ব্যক্তির জন্য বার্ষিক যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমে যাবে, তা ৫৮.৬ মেট্রিক টন কার্বন ডাইঅক্সাইডের সমতুল্য। বেশকিছু গবেষণাতেই প্রমাণিত হয়েছে, অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বৈশ্বিক পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। অনেক পরিবেশবাদীই মনে করেন, বর্তমানে আমরা যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি এগুলো অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে নয়, বরং মানুষের মাত্রাতিরিক্ত হারে ভোগের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘটছে।
অর্থনীতিন একটি মৌলিক ধারণা হলো: মানুষের সংখ্যা যত বেশি হবে, তারা তত সেবা ও পণ্য তৈরি করতে পারবে এবং বেশি ভোগ করতে পারবে- তাই অর্থনীতির সর্বোত্তম বন্ধু হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তবে একটি দেশে মোট কতজন মানুষ আছে তা দেশটির অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নয়। বরং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও হ্রাস পাওয়ার হারটিই কোনো দেশের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে যতই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেষ্টা করা হোক না কেন, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমাদের পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা কেবল বাড়তেই থাকবে। এ প্রবৃদ্ধি থামানো সম্ভব হবে না। ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে কোনো বৈশ্বিক দুর্ঘটনা, মহামারি, ভয়ংকর বিশ্বযুদ্ধ, এমনকি পৃথিবীর প্রতিটি দেশে এক-সন্তান নীতি গ্রহণ করা হলেও আগামী ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ১০০০ কোটিতে পৌঁছাবে।
এমনকি যদি কোনো বিপর্য়ের ফলে এ সেঞ্চুরির মাঝামাঝিতে পাঁচ বছর সময় ব্যবধানে পৃথিবীর ২০০ কোটি মানুষ মারা যায়, তাহলেও আগামী ২১০০ সালে বৈশ্বিক জনসংখ্যা হবে ৮৫০ কোটি।
পৃথিবীর মানুষ ক্রমশ কর্তৃত্বপরায়ণ ও প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। তাই ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে সবার সঙ্গে মিলেমিশে বাস করা ও পরিবেশ রক্ষা করার কোনো টেকসই উপায় খুঁজে পাওয়াটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে।
সূত্র: বিবিসি ফিউচার থেকে সংক্ষেপে অনূদিত।