মূলত মোবাইল চুরিকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটে

অনলাইন ডেস্ক:

জাতীয় একটি দৈনিকের বরাত দিয়ে হল সূত্রে জানা যায়, দুপুরে হলের মাঠে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার ক্রিকেট খেলা চলাকালীন ৬টা মোবাইল চুরি হয়ে যায়। পরবর্তীতে খেলা চলাকালীন ৮টার দিকে তোফাজ্জল হলে ঢুকলে তাঁকে আটক করেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের ধারণা, তোফাজ্জলই মোবাইল চুরি করছে। তাকে গেস্টরুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং হালকা মারধর করেন শিক্ষার্থীদের কয়েকজন। পরবর্তীতে তাকে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে আবারো গেস্টরুম নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন জানার পরেও তাঁকে ছাড়েননি অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম, সিনিয়র শিক্ষার্থীরা তাদের নানাভাবে বোঝানোর চেস্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

অনুসন্ধান ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায় তোফাজ্জলকে সবচেয়ে বেশি মারধর করেছেন ছাত্রলীগের সদ্য পদত্যাগ করা উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সুমন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ফিরোজ, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের আব্দুস সামাদ, ফার্মেসি বিভাগের মোহাম্মদ ইয়ামুজ জামান এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনিস্টিউটের মোত্তাকিন সাকিন। এরা সবাই ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থী।
হলের প্রত্যক্ষদর্শী একজন শিক্ষার্থী দেশ রূপান্তরকে ঘটনা বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমি হল গ্রুপে ৮টার সময় দেখি হলে চোর ধরা পড়েছে। হলের গেস্ট রুমে, গিয়ে দেখি চোর বসা। রুমে তখন ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারের অনেক ছেলে ছিল। গেস্টরুমে তাঁকে বেশি মারা হয়নি। ওখানে হালকা মারার পরে ক্যান্টিনে নিয়ে আসে খাওয়ানোর জন্য। তারপর শুনি তাঁকে এক্সটেনশন বিল্ডিং এর গেস্ট রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি তখন ওখানে গিয়ে দেখি ২০-২১, ২১-২২ ও ২২-২৩ সেশনের ব্যাচ। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ জন। ফার্স্ট ইয়ার যে ব্যাচটা ছিল, ওরা মারে নাই। ২০-২১ আর ২১-২২ সেশনের ওরা খুব বেশি মেরেছে।
তিনি আরও জানান, দুই-তিনজন মিলেই ওরে ওখানে মেরে ফেলছে। এরা হলেন— মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ২০-২১ সেশনের মোহাম্মদ সুমন, ওয়াজিবুল, ফিরোজ ও জালাল। এদের মধ্যে সুমন, ফিরোজ এবং জালাল সবচেয়ে বেশি মেরেছে। গেস্ট রুমে চোরের হাত বেঁধেছে জালাল। সুমন চোখ বন্ধ করে মেরেছে তাঁকে, মারতে মারতে ও (তোফাজ্জল) পড়ে গেছে। এরপরে পানি এনে তাঁকে পানি খাওয়ানো হলে সে উঠে বসে। এসময় সবাই হাততালি দেয়।’

ওই শিক্ষার্থী বলেন, সবাই খুশি হয় কারণ তাঁকে আবার মারতে পারবে। এরপর আবার শুরু হয় পেটানো। এই দফায়ও সবচেয়ে বেশি মেরেছে ফিরোজ। পরে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ১৮-১৯ সেশনের জালাল আসে। জালাল এসে আরও মারতে উৎসাহ দেয়; বলে— মার, ইচ্ছামতো মার; মাইরা ফেলিস না একবারে। এসময় গ্যাস লাইট দিয়ে পায়ে আগুনও ধরিয়ে দেয়। পরে সুমন এসে তোফাজ্জলের ভ্রু ও চুল কেটে দেয়।

ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, পরে ওখানে স্যার (হলের আবাসিক শিক্ষক) আসেন। আমি ওদেরকে অনেক ফেরানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু ওরা মানেনি। এক্সটেনশন বিল্ডিং এর গেস্ট রুম থেকে থেকে যখন তাঁকে বের করা হয় তখন স্যার এসে পড়ছেন। মারধরে তোফাজ্জলের ডান পা এবং বাম পায়ের মাংস খুলে পড়ে গেছে তখন। অনেকে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। আমি বলি কাপড় আনো, ওর পা বেঁধে দেই। কারণ ব্লিডিং হইলে তো সেন্সলেস হয়ে যাবে। পরে কাপড় এনে একটা জুনিয়র পা বেঁধে দেয়।

ওই শিক্ষার্থী জানান, মারধরকারীরা চেষ্টা করছিল মারপিট করে তাঁর স্বীকারোক্তি নিবে যে চুরি হওয়া ফোন সেই নিয়েছে। মারধরের এক পর্যায়ে দুই-তিনটা ফোন নম্বর দেয় তোফাজ্জল। সেই নাম্বারে ফোন দিলে অপর পাশ থেকে জানানো হয় মানসিক বিকারগ্রস্ত। কিন্তু ওরা (শিক্ষার্থীরা) বিশ্বাস করতে চায়নি। সেখানে আসা শিক্ষকদের সামনেও তোফাজ্জলকে পেটানো হয়। শিক্ষকরা বাধা দিতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

তিনি আরও জানান, পরে তোফাজ্জলকে হলের মেইন বিল্ডিংয়ের গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পরে জালাল প্রচুর মারে তাঁকে। বুট জুতা পরে এসে তোফাজ্জলের আঙ্গুল মাড়িয়ে ছেঁচে ফেলেন। আমি বলি, ভাই এগুলো কি করেন? তা শুনে হেসে দেয় জালাল। অনেকবার বলেছি, তারপরও সে বারবার হাতের আঙুল মাটিতে বিছিয়ে মাড়িয়েছে। তাঁর গোপনাঙ্গে লাঠি দিয়া জোরে জোরে আঘাত করছে জালাল। অনেক সিনিয়র ভাইয়েরা এসে তাদের ফেরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ওরা কিছুতেই মানেনি।

পরের ঘটনা জানিয়ে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, এরপর প্রক্টরিয়াল টিম আসে। কিছু অভিযুক্তরা টিমের কাছে তোফাজ্জলকে দিতে চাচ্ছিল না। তাঁরা বলছিল, প্রক্টরিয়াল টিমকে দিলে তাঁরা পুলিশকে দিবে, আর পুলিশ ছেড়ে দিবে। এ নিয়ে ওখানে প্রকটোরিয়াল টিমের সদস্যদের সাথে অনেক ঝগড়া হয়েছে। ২৫ মিনিট ধরে শিক্ষকরা তাদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন, মাইরো না, মাইরা তো কোনো ফল পাবে না। পুলিশে দাও, পুলিশ চেষ্টা করবে। যে আইন কানুন আছে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে প্রক্টরিয়াল টিম। কিন্তু স্যারদের কথা তাঁরা মানেনি। তাঁরা বলছে, আমরা দেখব। পুলিশের কাছে দিলে ওরা এই শর্তে দিবে যে, পুলিশ ওরে সার্চ করবে। যদি (ফোন) না পায় তাহলে ওকে আবার তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, পরে প্রক্টরিয়াল টিম বুঝতে পারে তোফাজ্জলের অবস্থা খুবই খারাপ। এত মারলে কেউ বাঁচতে পারে না। তার মাংসগুলো খসে পড়ে গেছে। তাঁর গোপনাঙ্গে প্রচুর আঘাত করা হয়েছে। আঙুলগুলো পুরো ছেঁচে ফেলা হয়েছে। ওই জালাল ছেলেটা করেছে। সবার সামনেই এগুলা করছে।

পরে অবস্থা খারাপ দেখে এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পাঁচ-ছয় জনের একটি দল তাঁকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে রাত ১২টার দিকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় চিকিৎসক তোফাজ্জল তাকে মৃত ঘোষণা করলে সটকে পড়েন ওই শিক্ষার্থীরা। এসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

মৃত শিক্ষার্থীর নাম তোফাজ্জল হোসেন । তিনি বরগুনার পাথরঘাটার সন্তান। বাবা-মাকে হারিয়ে মানুষিক ভারসম্যহীন হয়ে পড়েন বলেও তার এলাকায় পরিচিতি আছে।

 

শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top