পূর্ব লন্ডনের অল্ডগেট ইস্ট স্টেশনের খানিকটা উল্টো দিকে আডলার স্ট্রিটে একটা পার্ক আছে। নাম আলতাব আলী পার্ক। আলতাব আলী ছিলেন এক বাংলাদেশি পোশাকশ্রমিক। বাড়ি সিলেট। ১৯৭৮ সালের ৪ মে এই আডলার স্ট্রিটে তিন কিশোর বর্ণবাদী সন্ত্রাসীর হাতে তিনি প্রাণ হারান। তার হত্যার পেছনে মূল কারণ ছিল তার গায়ের বর্ণ। সেই পার্কেই ভাষা শহীদদের জন্য বানানো হয়েছে শহীদ মিনার। বর্ণবাদ বিষয়টি খুবই শক্তিশালী।
রাজ দরবারে গিয়ে যথারীতি নিয়ম মেনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ঋষি সুনাক। মাত্র সাত সপ্তাহ আগেই সেই লড়াইতে লিজ ট্রাসের কাছে হেরে যান ঋষি। কিন্তু শেষ হাসি হাসলেন তিনিই। যুক্তরাজ্যের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টির এই নেতা। তিনি ব্রিটেনের চলতি বছর দায়িত্ব নেয়া তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের পরের বাড়িটি অর্থাৎ ১১-তে তিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রী হিসেবে এবার সেই দশেই উঠে এলেন রাজকীয় ব্রিটেনের অ-শ্বেতাঙ্গ সরকার প্রধান হিসেবে। ঋষি মন্দের ভালো। ঋষি সুদর্শন। ঋষি বাদামি। ব্রিটেনের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে ঋষি সুনাক খুবই ধনী। সে জন্যই আম জনতার সঙ্গে তার একটা দূরত্বও রয়েছে। এ রকম অনেক গল্প ইতিমধ্যেই চাউর হয়েছে। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত কি না, তা নিয়ে উপমহাদেশে উল্লাস থাকলেও তার মগজে ব্রিটেনের স্বার্থের বাইরে কিছুই নেই। বাংলাদেশের ভেতরও ঋষি সুনাককে নিয়ে আলোচনা কম নয়।
গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই এটি, দলের ভেতর কতটা গণতন্ত্র চর্চা হলে দল প্রধানের সমালোচনা করা যায়, সংসদে স্বচ্ছতার ভেতর দিয়ে সরকার বদলানো যায়। আমাদের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলীয় সংসদ সদস্যরা শুধু জ্বি হুজুর, জ্বি হুজুর করেন সংসদে, কোন জন-গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনগণের পক্ষে দলের বাইরে ভোট দিতে পারেন না।
সুনাক মুনি ঋষি নন। তাই সেই পথে কোনকিছুর সমাধানও তার হাতে নেই। তীব্র জ্বালানি সংকট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে দিশাহীন যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির সঙ্গে তাকে সামাল দিতে হবে চরম বিভক্ত একটি রাজনৈতিক দলকে। সাবেক উপনিবেশগুলো থেকে মানুষের আগমন-এই প্রক্রিয়াকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্রিটেনের বিভিন্ন সরকার উৎসাহিত করেছে। এর পেছনে অবশ্য সস্তায় শ্রমিক আমদানির মতো এক অর্থনৈতিক ভাবনাও কাজ করে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, ভারত ও পাকিস্তান থেকে আগত মানুষের স্র্রোত ব্রিটেনের সমাজকে এক বহু সাংস্কৃতিক চরিত্র দিয়েছে। যেসব পরিবারকে এক সময় অভিবাসী বলে গণ্য করা হতো, তারাই আজ ব্রিটিশ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এসব পরিবার বিবিধ ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য ও অবদানের পরিচয় রাখছে। বিলাত দেশটি এক সময় এমন প্রতাপশালী ছিল যে, বলা হতো ব্রিটিশ শাসনের সূর্য নাকি অস্ত যায় না। যার মানে তাদের শাসিত এক দেশে ভোর হলে অন্য দেশে তখন গভীর রাত। ধীরে ধীরে সে দিন শেষ হতে হতে এখন আর ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। তারপরও আমাদের দেশ বা সমাজের তুলনায় যোজন যোজন এগিয়ে যে দেশ তার কাছে আমাদের যেমন ঋণ, তেমনি আছে শাসনের নামে শোষণের প্রতিবাদ।
সুনাক ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পর ৪২ বছর বয়সী ঋষিই শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-সেভেনে দ্বিতীয় অশ্বেতাঙ্গ সরকার প্রধান হচ্ছেন। সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে পরাস্ত হয়ে অক্টোবরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তার কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়া বিশ্বজুড়ে বহু মানুষকে যে চমকিত করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর অনেক কিছুই এখন বদলে গেছে। কোন দেশই কমফোর্ট জোন বা সুখের অবস্থানে নেই। আমেরিকার নাভিশ্বাস উঠছে। চীন আছে নানাবিধ সংকটে। ভারত এগোলেও তার সমস্যা পাহাড় সমান। বাংলাদেশ অনিবার্যভাবে ভুক্তভোগী। অস্তগামী সূর্যের দেশগুলো জানে তাদের সীমাবদ্ধতা। তারা এখন কালো চামড়া নামে পরিচিত তাদের দেশে আগত অভিবাসীদের মেধা মেনে নিচ্ছে। মেনে নিচ্ছে তাদেরও শাসিত হতে হবে। এই দৌড়ে ভারতীয়রা এগিয়ে। তারা মেধা আর কৌশলে নিজেদের জায়গা পোক্ত করে যাচ্ছে সব সময়।
ঋষি সুনাক কীভাবে যুক্তরাজ্যের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ এবং প্রথম হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হলেন, এই উত্থান নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-বিশ্বে ভারত ছাড়া অন্য এমন দেশ নেই, যে দেশের বংশোদ্ভূতরা ৩০টিরও বেশি দেশ শাসন করেছেন বা এখনো ক্ষমতার শীর্ষে রয়েছেন। ৪২ বছর বয়সী ঋষি সুনাকের নামও এবার সেই তালিকায় উঠে এল। ব্রিটেনের রাজনীতিতে খুব দ্রুতই উত্থান হয়েছে ঋষি সুনাকের। ২০১৫ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে প্রথমবার পার্লামেন্ট সদস্য হন সুনাক। আর তার মাত্র সাত বছরের মধ্যেই তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। বিরোধী দল লেবার পার্টির বর্ষীয়ান নেতা বীরেন্দ্র শর্মা সুনাককে খুব ভালো করেই চেনেন। দুজনেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত এমপি আর দুজনেরই যোগ রয়েছে পাঞ্জাবের সঙ্গে। ঋষি সুনাকের ব্যাপারে শর্মা বলেছেন, ‘আজ আমরা এমন একটা স্তরে এসে পৌঁছেছি, যেখানে স্থানীয় সমাজ এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছি। ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের অর্থনৈতিক ক্ষমতাও বেড়েছে। রাজনীতিতেও দেখা যায় যে প্রায় জনাচল্লিশেক এশীয় এবং কালো চামড়ার মানুষ পার্লামেন্টের সদস্য।’
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া একটা ঐতিহাসিক ঘটনা-ঠিক যে রকমটা হয়েছিল ২০০৮ সালে বারাক ওবামা যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ঋষি সুনাকের আগেও অবশ্য এশীয়রা ব্রিটেনের রাজনীতিতে মন্ত্রী আর মেয়র হয়েছেন, বেশকিছু শীর্ষপদেও তারা আসীন হয়েছেন। যেমন প্রীতি প্যাটেল ব্রিটেনের হোম সেক্রেটারি হয়েছিলেন আর লন্ডনের মেয়র হন সাদিক খান। তবে প্রধানমন্ত্রীর পদ পর্যন্ত আর কেউ পৌঁছতে পারেননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সুনাকের উত্থান আসলে এশীয়দের সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত। ঋষি সুনাকের পরিবার তিন প্রজন্ম ধরেই ভারতের বাইরে বসবাস করে। তার দাদা-দাদি দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগেই বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে পূর্ব আফ্রিকায় পালিয়ে যান। অনেক বছর বাদে তারা যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন শহরে এসে বসবাস করতে থাকেন।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ব্রিটেনের সব থেকে ধনী যে ২৫০টি পরিবার, তার মধ্যে মি. সুনাকের নামও রয়েছে। অথচ ঋষি সুনাকের বাবা যশবীর সুনাক চিকিৎসক আর তার মা ঊষা সুনাক কিছুদিন আগে পর্যন্তও একটা ওষুধের দোকান চালাতেন। তারা সাউদাম্পটনেই থাকেন এখনো। ঋষি সুনাক একটা সাধারণ হিন্দু ধর্মীয় পরিবারেই বড় হয়েছেন।
নিজের ওয়েবসাইটে সুনাক লিখেছেন, ‘আমার বাবা-মা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যাতে আমি একটা ভালো স্কুলে পড়াশোনা করতে পারি। আমি ভাগ্যবান যে উইনচেস্টার কলেজ, অক্সফোর্ড আর স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি।’
সুনাক মুনি ঋষি নন। তাই সেই পথে কোনকিছুর সমাধানও তার হাতে নেই। তীব্র জ্বালানি সংকট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে দিশাহীন যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির সঙ্গে তাকে সামাল দিতে হবে চরম বিভক্ত একটি রাজনৈতিক দলকে
৪২ বছর বয়সী ঋষি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক কে এই ঋষি? যশবীর এবং ঊষা সুনাকের কোল আলো করে ১২ মে ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন শহরে জন্ম নেন ঋষি। তিন ভাইবোনের মধ্যে ঋষি বড়। পিতা যশবীরের জন্ম কেনিয়ার। মাতা ঊষার জন্ম বর্তমান তানজানিয়ায়। যশবীর পেশায় চিকিৎসক এবং ঊষা ছিলেন ফার্মাসিস্ট যিনি স্থানীয় ফার্মেসি চালাতেন। অনেকেই ধারণা করছেন ঋষী সুনাক ভারতীয় বংশোদ্ভূত। উইকিপিডিয়া বলছে ‘ঋষির দাদা-দাদি ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬০-এর দশকে তাদের সন্তানদের সঙ্গে পূর্ব আফ্রিকা থেকে যুক্তরাজ্যে চলে আসেন।’ এ দিকে সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ গবেষণা বিষয়ের এক অধ্যাপক টুইটারে দাবি করে লিখেছেন, ‘ঋষি সুনাকের দাদা-দাদি পাকিস্তানের গুজরানওয়ালা, ঋষির বাবা-মা নাইরোবি, কেনিয়ার। ঋষির জন্ম যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন শহরে।’ ফলে ঋষি আসলেই কোন দেশের বংশোদ্ভূত তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
ঋষির জন্য অপরিবর্তনযোগ্য রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, তিনি যা-ই করেন না কেন, নিজের গায়ের রং এবং নাম তো আর বদলাতে পারবেন না। বর্ণবাদের চেহারা যুক্তরাজ্যে ভয়ংকর। জনপ্রিয় পত্রিকা ডেইলি মিরর তো শিরোনামই করে, ‘আমাদের নতুন অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, তোমাকে ভোট দিয়েছে কে?’ বাকিদের অনেকে শিরোনাম করে, ঋষির নিজের দলের এমপিদের জন্য করা মন্তব্য ‘এক হও নয় মরো’ দিয়ে। তার এই মন্তব্যেই ফুটে উঠে তার আসল অসহায়ত্ব এবং বর্ণবাদী রাজনৈতিক বাস্তবতা।
প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। বর্ণবাদ এবং অভিবাসন বিরোধের রোগ এখন শুধু শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেই সীমিত নয়। সাদা ভিন্ন অন্য বর্ণের মানুষের ভেতরও তা ছড়িয়ে পড়েছে। জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হয়, ‘সেই শুভরাষ্ট্র ঢের দূরে আজ’।
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]