ঝিনাইদহ প্রতিনিধি-
ঝিনাইদহে পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করে মানবাধিকার হরণের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। সোমবার (২৭ জানুয়ারি) সকালে ঝিনাইদহ শহরের পায়রা চত্বরে এ সংবাদ সম্মেলন করেন, মহিলা আঞ্জুমান নামে একটি সংগঠন। এতে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে শতাধিক পর্দানশীন নারীরা অংশ নেই। এসময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, ঝিনাইদহ মহিলা আঞ্জুমান সংগঠনের প্রতিনিধিগণ। তারা বলেন, গত ১৬ বছর যাবত ইসির কতিপয় স্বৈরাচারী কর্মকর্তা শুধুমাত্র ছবির অজুহাতে পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব আটকে রেখেছে, যা এক প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধ। এতে পর্দানশীন নারীরা মৌলিক ও নাগরিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে নিদারুণ কষ্ট করছেন। যে বা যারা গত ১৬ বছর যাবত নারীদের মানবাধিকার হরণ করেছে আমরা তাদের বিচার চাই। তারা তাদের ধর্মীয় অধিকার এবং প্রাইভেসির অধিকার অক্ষুন্ন রেখে এন আই ডি এর দাবি জানান। এছাড়াও তারা বলেন, একজন নারী ছবি তুললে দুইটি গুনাহ হয়। একটি হল ছবি তোলার গোনা, অন্যটি বেপর্দা হওয়ার গুনাহ। আমরা পর্দানশীন নারীরা সেই গুনাহ থেকে বাঁচতে চাই। তারা বলেন, কর্মকর্তারা আমাদের নাগরিকত্ব আটকে রেখে সেই গুনাহ করতে বাধ্য করতে পারে না। ঝিনাইদহ মহিলা আঞ্জুমানের প্রতিনিধিগন আরো বলেন, আমি আমার চেহারা কাউকে দেখাবো না। এটা আমার গোপনীয়তা বা প্রাইভেসীর অধিকার। অর্থাৎ পর্দানশীন নারীদের আজকের এই দাবি শুধু ধর্মীয় অধিকারের মধ্যে পড়ে না, প্রাইভেসির অধিকারের মধ্যেও পড়ে। ফলে দুই দিক থেকেই পর্দানশীন নারীদের দাবি মানবাধিকার ও সংবিধানিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিনিধিগণ বলেন, এনআইডি ছাড়া পর্দানশীন নারীরা মৌলিক ও নাগরিক অধিকার হারিয়ে মানবতার জীবনযাপন করছেন। অনেক পর্দানশীন নারী অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন কিন্তু এনআইটি ছাড়া ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রি করতে পারছেন না। অথচ সম্পত্তি বিক্রি করতে পারলে তিনি চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারতেন। অনেকের দুর্ঘটনায় বাড়ি ঘর আগুনে পুড়ে গেছে কিন্তু এনআইডি ছাড়া ত্রাণ নিতে পারছেন না। অনেক বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত পর্দানশীন নারী এন আই ডির অভাবে বাসা ভাড়া করতে পারছেন না। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করতে পারছেন না। পর্দার সাথে কোন চাকরি করে জীবন নির্বাহ করতে পারছেন না। গত ১৬ বছর যাবৎ পর্দানশীন নারীদের সাবেক ইসি কর্মকর্তারা যে কষ্ট দিয়েছে তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। তারা বলেন, গত জুলাই আগস্ট এর ছাত্র জনতা অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। গত ১৬ বছর শুধুমাত্র পরিপূর্ণ পর্দা করার কারণে নারীদের সাথে যে বৈষম্য হয়েছে আমরা এই বৈষম্যের পরিসমাপ্তি চাই। অবিলম্বে পর্দানশীন নারীদের ধর্মীয় ও প্রাইভেসির অধিকার অক্ষুন্ন রেখে এন আই ডি প্রদান করা হোক। আঞ্জুমানের প্রতিনিধিগণ আরও বলেন, এনআইডির মুখচ্ছবি পরিবর্তনযোগ্য। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মুখচ্ছবি পরিচয় যাচাইয়ের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম নয়। অথচ সেই মুখচ্ছবির অজুহাতেই নারীদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করা হচ্ছে। এছাড়া ছবি দিয়ে সনাক্তকরণ দুর্নীতিবান্ধব পদ্ধতি, অপরদিকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে সনাক্তকরণ দুর্নীতি রোধক পদ্ধতি। যেমন আগে ব্যাংকগুলোতে ছবি দেখে পরিচয় যাচাইয়ে একজন ব্যক্তির একাধিক পরিচয় পত্র উত্তোলনের মত প্রতারণার ঘটনা ঘটে এ প্রতারণার উক্তি বর্তমানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবার ছবি দেখে পরিচয় যাচাইয়ে একজন ব্যক্তির একাধিক এনআইডি তৈরির মতো ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে দ্বৈত এন আই ডির সমস্যাও দূর হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের মাধ্যমে। আবার একটা সময় বাংলাদেশীদের সাথে চেহারার মিলকে পুঁজি করে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশী পাড়ি জমায়, কিন্তু যখনই তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে যাচাই শুরু হয়, তখনই রোহিঙ্গাদের প্রতারণা ধরা পড়ে এবং সমস্যার সমাধান হয়। আবার দেখা যায় অপরাধীরা বারবার রূপ বদলানোয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য চেহারার ছবি দেখে অপরাধীকে ধরা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। অনেক সময় চেহারার মিল থাকাই নিরাপরাধ ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে ধরা পড়ে যাই। এই সমস্যা সমাধানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধী সনাক্তে ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তির আশ্রয় নিচ্ছেন। যেমন- এলিট ফোর্স র্যাব ফিঙ্গারপ্রিন্টের ওআইভিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, পুলিশের সিআইডি ফিঙ্গারপ্রিন্টের এএফআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ নির্ভুল যাচাইয়ের জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট এখন সর্বাধুনিক ও গ্রহণযোগ্য মাধ্যম। উল্লেখ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে ছবির অপব্যবহার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এক ছবি একাধিক লোক ব্যবহারের প্রযুক্তিও আবিষ্কার হয়েছে। এসব কারণে আধুনিক বিশ্ব মুখচ্ছবি দেখে পরিচয় যাচাই বর্জন করেছে। তাই পর্দানশীন মহিলাদের এনআইটি প্রদানে আইনেও কোন বাধা নেই। বিশেষ করে পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০ এবং ২০২৩ এ পরিচয় সনাক্তে চেহারার ছবির কথা উল্লেখ নাই। এমনকি বায়োমেট্রিক যাচাইয়ে ফেসিয়াল রিকগনিশনকেও বাধ্যতামূলক করা হয়নি। কিন্তু তারপরও স্বৈরাচারী মনোভাব থেকেই পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করে রেখেছিল সাবেক ইসি কর্মকর্তারা। পর্দানশীন নারীরা চান নতুন ইসি কর্মকর্তারা আর সেই পথে না হাটুক। পর্দানশীন নারীদের ধর্মীয় ও প্রাইভেসির অধিকার অক্ষুন্ন রেখেই অবিলম্বে তাদের এনআইটি প্রদান করুক। এ বিষয়ে ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমানের প্রতিনিধিগণ ঝিনাইদহ জেলা নির্বাচন অফিসারের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে তিনটি দাবি উত্থাপন করেছেন বলেও জানান তারা। দাবী তিনটি হল, বিগত ১৬ বছর যাবৎ পর্দানশীন নারীদের মানবাধিকার হরণ করা ইসি কর্মকর্তাদের বিচার করা, পর্দানশীন নারীদের ধর্মীয় ও প্রাইভেসির অধিকার অক্ষুন্ন রেখেই এনআইডি প্রদান করা হোক এবং পর্দানশীন নারীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়ায় মহিলা অফিস সহকারী বাধ্যতামূলক করা। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, ঝিনাইদহ মহিলা আঞ্জুমান সংগঠনের পক্ষ থেকে আহমদ হুমায়রা, সাদিয়া লায়ল,আহমদ লুৎফা ও আহমদ মানসুরা।