বাংলাদেশের স্থাপত্যে বিশ্বজয় করলো ঝিনাইদহের পৌর ইকোপার্ক 

সবুজ মিয়া, ঝিনাইদহ থেকে-

ব্রিটিশ আমলের ঐতিহাসিক ঝিনাইদহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত দেবদারু এভিনিউটি, যা  ইকো পার্ক নামেও পরিচিত। এখানকার নান্দনিক স্থাপনা সব সময়ই দৃষ্টি আকর্ষণ করে মন জুড়িয়ে নেয়। তার সঙ্গে যদি সার্বিকভাবে জীবনের গুণগত মানোন্নয়নের দিক বিবেচনায় থাকে, তা হয় সব থেকে আলাদা। শতবর্ষী গাছ বাঁচিয়ে শহরের মানুষের জন্য করা হয়েছে বসার জায়গা। বয়স্করা পেয়েছে হাঁটাচলার স্থান। প্রকৃতি আর মানুষের সহাবস্থানের নকশা জিতে নিয়েছে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার। আন্তর্জাতিক আগাখান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার ২০২২ এ সংক্ষিপ্ত তালিকার ২০টি প্রকল্পের মধ্যে স্থান পেয়েছে ঝিনাইদহের এই ইকো পার্কটিও। ঝিনাইদহের ইকো পার্ককে বিশ্বের ৪৬৩টি প্রকল্প থেকে নির্বাচকরা বাছাই করেছেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যতিক্রমী একটি পার্ক ঝিনাইদহের দেবদারু এভিনিউ বা ইকো পার্ক। ব্যতিক্রমি এই কারণে যে, এই পার্কটির নামকরণ হয়েছে কয়েকটি দেবদারু গাছকে ঘিরে। ইকো পার্কটিতে বুকের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে শতবছরের বিশালাকার কয়েকটি দেবদারু গাছ। এক সময় এই গাছগুলোই ছিল ঝিনাইদহ শহরের বুক চিরে চলা একমাত্র নদী নবগঙ্গার ধার। গাছগুলোর আছে বিশেষ নান্দনিকতা । আধুনিকায়ন করে সাধারণ মানুষের জন্য পরবর্তীতে এ পার্কটি স্থাপন করা হয়। এখানে প্রতিটি গাছের নিচে বসার বেদি করা হয়েছে । এই গাছগুলোকে রেখেই বর্তমান ইকো পার্ক বা ঝিনাইদহ দেবদারু এভিনিউ। এক কথায় বলা যায়, ব্রিটিশ আমলের দেবদারু গাছগুলোই যেন এ পার্কটিকে সন্তানের মতো ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছে বছরের পর বছর। আর এটি জনগুরুত্বপূর্ণ পার্ক তো বটেই । কারণ, ঝিনাইদহ শহরে যখন সাধারণ মানুষের ঘোরার বা সময় কাটানোর জায়গাই ছিল না তখনই বিশেষ ও ব্যতিক্রমী ইন্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমেই স্থাপন করা হয় ইকো পার্কটি। একপাশে ঝিনাইদহ শহরের প্রাণ নবগঙ্গা নদী আর ঠিক তার কুল ঘেষে পার্কটি । যেন টেমস নদীর কুল ।এ দেবদারু এভিনিউ বা ইকো পার্কের পাশে আছে সরকারী বেশ কয়েকটি স্থাপনা। পাশে আছে জেলা রেজিষ্ট্রি অফিস, আছে জেলা শিল্পকলা একাডেমি, আছে জেলা প্রশাসকের বাংলো, আছে পুরাতন জেলখানা।
জেলা শহরের জন্য তো বটেই এ পার্কটি মহাগুরত্বপূর্ণ। সপ্তাহের ৭ দিনই পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা থাকে পার্কটি। ঢুকতে কোন টাকাই লাগে না। কয়েকটি খাবারের দোকানও আছে সাধারন মানুষের জন্য। ঝিনাইদহ ইকো পার্কটির পাশেই রয়েছে মসজিদ ও মাদ্রাসা। যে কেউ ইচ্ছে করলেই নামাযও সেরে নিতে পারেন যে কোন সময়। শহর থেকে মাত্র ৫/১০টাকা ভাড়া দিয়ে ইজিবাইক-ভ্যান কিংবা রিক্সা করে যে কেউ যখন-তখন বেড়িয়ে আসতে পারেন ।
ইকো পার্কটির ওপর পাশে রয়েছে ঝিনাইদহ শহরের জনগুরুত্বপূর্ণ পাড়া আরাপপুর। দ্বি-স্তর বিশিষ্ঠ এ পার্কে যত সময় খুশী যে কেউ নিতে পারেন নির্মল বাতাস। উপভোগ করতে পারেন প্রাকৃতিক এক নতুন চেহারা। একসময়ের ছোট্ট পার্কটি আজ শতশত মানুষের ভীড় লেগেই থাকে সবসময়।
এক কথায় এটি একটি ঐতিহাসিক পার্ক। কেননা ব্রিটিশ আমলের সেই গাছগুলোকে বাঁচিয়ে চরম নান্দনিকতাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রাতে পার্কটি আরো উপভোগ্য হয়ে ওঠে। নিরাপত্তা জনিত কোন সমস্যা নেই। স্বপরিবারে ঘুরতে আসলে বাচ্চাদের দৌড়ে ছুটে চলার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত জায়গা। তিনটি স্থানে আছে সিঁড়ি। রাতের আলোঝলমলে পার্কে যে কেউ প্রিয়জনকে নিয়ে সুন্দর সময় কাটাতে পারবেন নির্দিধায়। ঝিনাইদহ দেবদারু এভিনিউ বা ইকোপার্ক জেলাবাসীর গর্বের একটি জায়গা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর তীর ঘেঁষে হাঁটার রাস্তা, বাগানের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা ও সংস্কৃতিচর্চার জায়গা তৈরি। পরিবেশের পাশাপাশি নগরায়নের মিশ্রণের অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে এটি। শত বছরের দেবদারু গাছগুলোকে তার নিজস্ব স্বকীয়তায় থাকতে দেওয়া ও পাশ দিয়ে বয়ে চলা শহরের মধ্যের একমাত্র নদী নবগঙ্গাকে দখলমুক্ত করে তার নিজস্ব গতীতে বহমান রাখা। প্রকৃতির সবলিলা সৌন্দর্যমন্ডিত ও উপভোগ্য করে তোলায় পৌর ইকো পার্কটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তিতে ভুমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন জেলার বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গরা। এখানে আছে আধুনিক শৈলীকতায় পরিপূর্ণতা। আছে পাখির কিচির-মিচির, নির্মল বাতাস, ছায়ায় বসে একদারু নিজেকে সতেজ করার সবকিছুই । অন্যদিকে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার প্রাপ্তিতে গর্বিত হয়েছে ঝিনাইদহ জেলাবাসি ও বাংলাদেশ । পরিবার নিয়ে ঘুরতে আাসা শৈলকুপা উপজেলার দর্শনার্থী ইকতিয়ার হোসেন, রাশিদুল বিশ্বাস জানান, শহরের মধ্যে নদীর ধারে এমন স্থাপনা খুব কমই দেখা যায়। প্রকৃতিকে তার নিজস্ব অবস্থানে রেখে আরো সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয়েছে। আমরা স্বপরিবারে এসেছি দেখতে। আমাদের খুবই ভালো লাগছে।

দর্শনার্থী সুরাইয়া বেগম জানান, ঝিনাইদহ শহরে খুব একটা ঘোরাঘুরির স্থান নেই । আমরা শহরের বাসিন্দা।সুযোগ পেলেই এখানে পরিবারের অন্যসদস্যদের নিয়ে চলে আসি।
বিনা পারিশ্রমিকে ডিজাইন করা প্রকৌশলী খোন্দকার হাসিবুল কবির জানান, আমাদের করা কাজের স্বীকৃতি সবাইকেই আনন্দ দেয়। আমাদের এ কাজ এমন পুরস্কার পাবে কখনও ভাবিনি । এ ধরনের কাজ করতে পারাটাও ভাগ্যের ব্যাপার। নদী এবং প্রকৃতিকে মিলিয়ে ঝিনাইদহ পৌরসভা ইকো পার্ক গঠিত হয়েছে।
তিনি আরো জানান, তার স্ত্রী প্রকৌশলী সোহেলী ফারজানাসহ আরো অন্তত ৫০ জন ডিজাইনার ও প্রকৌশলীরা এ মহাকর্মযজ্ঞে অংশ নেই । এখন পর্যন্ত মাত্র ৪০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে । বাকী কাজ শেষ করতে লাগবে আরো কয়েক বছর । তিনি জানান, শতবছরের দেবদারু গাছগুলোই মুলত এর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুন।
পৌর ইকো পার্কটি তৈরিতে প্রধান উদ্যোক্তা জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও সাবেক পৌরসভার মেয়র আলহাজ্ব সাইদুল করিম মিন্টু জানান, ভালো কাজ করতে সবসময়ই ঝুঁকি নিতে হয়। আমরা সবাই মিলে নদীকে দখলমুক্ত করতে চেয়েছি। প্রকৃতির নিজস্ব সৌন্দর্য রেখে এ কাজটি করেছি। এমন পুরস্কার পাবো তখন তো ভেবে করিনি। এ প্রাপ্তি পুরো পৌরবাসির তথা দেশের । তিনি আরো জানান, ঝিনাইদহ পৌর ইকো পার্ক তৈরিতে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২ কোটি টাকা। যার মধ্যে ইউজিপির টাকা ১ কোটি ১৫ লাখ আর বাকী টাকা ঝিনাইদহ পৌরসভার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে তৈরী। পুরোটা শেষ করতে ৫কোটি টাকা খরচ হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top